মুখবন্ধ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবীর স্বাভাবিক আবহাওয়ার বহু পরিবর্তন ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলো নেতিবাচক। এই উষ্ণায়নের কারণ পুরোটাই মনুষ্যসৃষ্ট। শিল্পায়ন শুরু হয়েছে ১৭৫০-৬০ নাগাদ এবং ঐ সময়ের ১০০ বছর পরে শিল্পায়নের ধারা ব্যাপক হয়েছে। ১৮৫০ থেকে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া আরও বিস্তৃত হয়েছে। বিভিন্ন প্রকারের যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ফলশ্রুতিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। তার সাথে মিথেন,নাইট্রাস অক্সাইড এবং হেক্সাফ্লোরো কার্বনের উৎপাদনও বেড়ে চলেছে। এই গ্যাসগুলোর তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা আছে; এদের গ্রিন হাউজ গ্যাস বলা হয়। ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং তার প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং সময়কাল বদলে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বন্যার প্রকোপ বাড়ছে; একইসাথে খরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। নগরগুলোতে অল্পসময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। নদীভাঙন বাড়ছে; সমুদ্র উপকূল ভাঙছে; ভূমিধ্বস হচ্ছে; পোকামাকড় বাড়ছে; সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার ফলে উপকূলবর্তী নিচু জায়গায় সমুদ্রের পানি ঢুকার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে এবং উপকূল অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বাড়ছে। গাছের ফুল ফোটার সময়কাল বদলে যাচ্ছে এবং পরাগায়ন প্রক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে। এতে করে জীববৈচিত্র ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে; খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে খাদ্য ঘাটতির আশংকা দেখা দিচ্ছে। রোগবালাই বাড়ছে; বিশেষ করে ভেক্টর বাহিত জীবাণুগুলোর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। সমুদ্রে মাছের আবাসস্থল পরিবর্তিত হচ্ছে। বজ্রবিদ্যুতের পরিমাণ বাড়ছে। সামুদ্রিক প্রবালগুলো রং হারিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইন্টেন্সিটি এবং ফ্রিকোয়েন্সি,দুটোই বাড়ছে এবং পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশ্ব অত্যন্ত চিন্তিত। এই দুর্ভোগগুলো নেমে আসছে মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণেই এবং এটি নিশ্চিত করে বলা হয়েছে ২০০৭ সাল থেকে। বর্তমানে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আগের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১ থেকে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ তা বেড়ে ২ ডিগ্রির বেশি হতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া মোকাবেলায় বিশ্বজুড়ে দুটি ধারায় আলোচনা চলছে। প্রথমটি বিজ্ঞানভিত্তিক; ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ বা আইপিসিসির মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ থেকে নির্বাচিত বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে এই ধারার আলোচনা চলছে। এর ষষ্ঠ রিপোর্টের প্রথম খণ্ড,যেটিতে বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখা রয়েছে,সেটি ২০২১ সালের আগস্টে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ড,যেটিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলো মোকাবেলা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে,সেটি ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। এবং তৃতীয় খণ্ড,যেটিতে এই গ্যাসগুলোর কারণে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে,তা প্রশমনের কথা বলা হয়েছে; সেটি এপ্রিল ২০২২এ প্রকাশিত হয়। আর চতুর্থ রিপোর্ট,যেটি নীতিনির্ধারকদের জন্যে সামারি রিপোর্ট,সেটি ২০ মার্চ ২০২৩ এ প্রকাশিত। এই রিপোর্টে বিজ্ঞানীরা বিশ্ববাসীকে চূড়ান্ত সতর্ক সংকেত বা রেড এলার্ট জ্ঞাপন করেছে। উষ্ণায়ন নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনার দ্বিতীয় ধারাটি রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিতে রচিত। ১৯৯২ সালে ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) প্রণীত হয়। এই কনভেনশনের অধীনে ১৯৯৭ সালে প্রশমনের জন্য কিয়োটো প্রোটোকল অনুমোদিত হয়। ২০১৫ সনে প্যারিস এগ্রিমেন্ট নামে একটি বৈশ্বিক আইন তৈরি হয়। সকল দেশ ইউএনএফসিসিসি এবং প্যারিস এগ্রিমেন্টের দেয়া লক্ষ্যাবলি ও প্রস্তাবিত কর্মকাণ্ডসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। প্রতিবছর নভেম্বর/ডিসেম্বর মাসে পৃথিবীর সকল দেশ একত্রিত হয়ে কনফারেন্স অফ পার্টিস বা কপে এই চুক্তিগুলোর ভিত্তিতে প্রণীত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে এবং আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং তার প্রভাবে আবহাওয়া পরিবর্তন এখন বৈজ্ঞানিক আলোচনার ভিত্তিতে দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত। আগামী ৬০-৭০ বছরের মধ্যে পৃথিবী বহু বিষয়ে হুমকির মুখোমুখি হবে। প্রধান হুমকিটি আসবে খাদ্য উৎপাদন নিয়ে। এই কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে খাদ্যঘাটতি দেখা দিতে বাধ্য। সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বহু নিচু স্থান ডুবে যাবে। যদি বাংলাদেশে যশোর থেকে গোপালগঞ্জ,গোপালগঞ্জ থেকে চাঁদপুর,এবং চাঁদপুর থেকে ফেনী পর্যন্ত একটি লাইন টানা যায়,তাহলে তার দক্ষিণাংশ সমুদ্রের অংশ হয়ে যেতে পারে। আগামী শতাব্দীর আগেই ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা বাড়া এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বাড়ার কারণে আক্রান্ত এলাকা থেকে মানুষ দেশান্তরিত হতে বাধ্য হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। যেসব কারণে এটি হচ্ছে,তা নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে প্রশমন এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলো মোকাবেলার পদ্ধতির নাম হচ্ছে অভিযোজন। এই দুইটি বিষয়ে বৈশ্বিকভাবে সিরিয়াসলি আলোচনা চলছে,এবং করণীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হচ্ছে যা বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন হবে; প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রয়োজন হবে; এবং দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ প্রশমনের ক্ষেত্রে তেমনভাবে দায়ী নয়,কিন্তু অভিযোজনের ক্ষেত্রে তাকে বিরাট ভূমিকা পালন করতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরূপ প্রতিক্রিয়াতে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ভুগবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কাজেই বিভিন্ন পর্যায়ের বৈশ্বিক আলোচনায় বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের সরকার ইতোমধ্যে দুটি বিষয়েই জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এখন তার সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আমি মনে করি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনের বিকল্প নেই। এই বিষয়ের একজন নিবিড় গবেষক,বৈজ্ঞানিক নাভিদ সালেহ রচিত ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন: প্রয়োজনীয় ও সংক্ষিপ্ত পাঠ’’ বইটি এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান ও সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে কাজে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি। অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক এমিরিটাস,ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
Tk.
270
203
Tk.
600
450
Tk.
50
30
Tk.
287
261
Tk.
2000
1900
Tk.
240
132
Tk.
990
640
Tk.
250
167